যে কোনো কোম্পানির অগ্রগতিতে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা হচ্ছে তার এমপ্লয়িদের। আপনার কোম্পানিতে যাদের নিয়োগ দিচ্ছেন তাঁদের পর্যাপ্ত যোগ্যতা এবং কাজের প্রতি ভালোবাসা আছে কিনা সেটা অনেকাংশেই নির্ধারণ করবে কোম্পানির ভবিষ্যৎ। তাই প্রতিভাবান ব্যক্তিদেরকে নিজের দলে ভেড়াতে উঠে পড়ে লাগার সময় এখনই।
কোম্পানি কালচারের গুরুত্ব
বিভিন্ন গবেষণায় পাওয়া গেছে যে সেরা যোগ্যতাসম্পন্ন কর্মজীবীদের কোম্পানিতে নিয়োগ দিতে পারা না পারার পেছনে কোম্পানি কালচারের ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
ইতিবাচক পরিবেশে, বিশেষ করে যেখানে সহকর্মীদের সাথে কাজ করাটা উপভোগ্য – সেখানে সাধারণত চাকরিজীবীরা বেশি মনোযোগ আর নিষ্ঠার সাথে কাজ করেন। একইভাবে, বন্ধুসুলভ কালচার থাকলে কর্মজীবীদের চাকরি পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে ম্যানেজারদের সাথে কথা বলার সম্ভাবনাও বেশি থাকে। তাই কোম্পানিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইলে একটি সুস্থ ও সহজাত পরিবেশ গড়ে তোলাটা খুবই জরুরি।
সুস্থ কালচার গড়ে তোলা যায় কীভাবে?
প্রথমত, আপনার কোম্পানিতে কী কী উপায়ে ইতিবাচক পরিবেশ স্থাপন এবং একইসাথে তার প্রচারণা করা সম্ভব তা নিয়ে ভাবুন। এর জন্য আপনি নানান রকম পন্থা অবলম্বন করতে পারেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিয়মিত উপস্থিতি থেকে শুরু করে কমিউনিটির সবার অংশগ্রহণের সুযোগ রেখে আয়োজিত প্রতিযোগিতা পর্যন্ত বিভিন্ন রকম ভাবে একটি কোম্পানিকে যেমন অভ্যন্তরীণভাবে উজ্জীবিত রাখা যায়, তেমনি ইন্ডাস্ট্রির বাকিদেরকেও সে বিষয়ে অবগত করা যায়।
এছাড়া এমপ্লয়িদের সাথে কোম্পানি কেমন আচরণ করে এবং কী কী সুবিধা দেয় সে বিষয়ে শুরু থেকেই স্বচ্ছ থাকা সুস্থ কালচারের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
এবার আর্টিকেলের মূল অংশে আসা যাক। কীভাবে সেরা প্রতিভাবান কর্মজীবীদের কোম্পানিতে নিয়োগ দেবেন এবং চাকরিতে ধরে রাখবেন?
১। জব ফেয়ারে অংশগ্রহণ করুন
যোগ্য এমপ্লয়ি নিয়োগ দেওয়ার সবচেয়ে ভালো জায়গা হচ্ছে স্থানীয় সংগঠনগুলোর আয়োজিত রিক্রুটিং ইভেন্ট। তবে আপনার কোম্পানির চাকরিজীবীরা এই আয়োজনের ব্যাপারে যেন আগে থেকেই অবগত থাকে তা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে, যাতে করে প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত সময় পাওয়া যায়।
এ ধরনের পরিবেশে উপস্থিত থাকা কোম্পানির ব্র্যান্ডিং-এও সহায়তা করে যার ফলস্বরূপ চাকরির সন্ধানের সময় ইন্ডাস্ট্রির অনেকের শুরুতেই আপনার কথা মাথায় আসবে।
২। ইন্টারভিউয়ের পর ফিডব্যাক দিন
চাকরির জন্য কোনো ক্যান্ডিডেটের ইন্টারভিউ নেওয়ার সময় তাকে যতটা সম্ভব স্বচ্ছন্দ্য ও স্বাগত বোধ করানোর চেষ্টা করুন। আর চাকরি হোক না হোক, ইন্টারভিউয়ের পর ক্যান্ডিডেটকে ফিডব্যাক দেওয়াকে প্রাধান্য দিন।
একজন ব্যক্তির যদি চাকরি নাও হয়, আপনার দেওয়া ফিডব্যাক তাকে নিজের দক্ষতা বাড়াতে সহায়তা করবে যা ভবিষ্যতে তাকে এই চাকরির জন্য একজন উপযুক্ত ক্যান্ডিডেটে পরিণতও করতে পারে। তবে কারও দুর্বলতার ব্যাপারে ফিডব্যাক দেওয়ার সময় অন্য কেউ যেন তা জানতে না পারে সেই নিরাপত্তা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে।
৩। অনলাইনে অ্যাপ্লিকেশন গ্রহণ করুন
এখনও অনেক কোম্পানি কাগজে লেখা বা প্রিন্ট আউট করা আবেদন গ্রহণ করে। বর্তমান ডিজিটাল যুগে অফিসে গিয়ে লিখিত অ্যাপ্লিকেশন বা সিভি জমা দিয়ে আসা খুব একটা বাস্তবসম্মত কাজ নয়। এতে বরং আবেদনকারীদের কাছে আপনার কোম্পানির প্রযুক্তি বিমুখীতা প্রকাশ পায়।
আর তাছাড়া কাগজ কলমে সিভি ও অ্যাপ্লিকেশন লিখতে বা প্রিন্ট করতে যে অতিরিক্ত সময় প্রয়োজন, ব্যস্ত জীবনে অনেকেই এই বাড়তি ঝামেলাটা নিতে চান না। বিশেষ করে বর্তমানে চাকরি অ্যাপ সহ বিভিন্ন জব পোর্টাল চাকরিতে আবেদন করার কাজটাকে অনেক বেশি সহজ করে দিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে অনলাইনে অ্যাপ্লিকেশন গ্রহণ না করা মানে একটি বড় সংখ্যক যোগ্য ক্যান্ডিডেট হাতছাড়া হয়ে যাওয়া।
আর তাছাড়া প্রযুক্তিভিত্তিক এইচ আর সল্যুশনের ব্যবহার এইচ আর ম্যানেজারদের কাজও অনেক কম সময়সাপেক্ষ করে দিয়েছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা একটানা বসে হাজার হাজার সিভির পাহাড় ঘেঁটে যোগ্য ক্যান্ডিডেট খুঁজে বের করার দিন এখন আর নেই।
এতো সবকিছুর পর পছন্দমতো ক্যান্ডিডেট তো পেয়ে গেলেন, এবার তাকে ক্যান্ডিডেট থেকে এমপ্লয়িতে পরিণত করবেন কীভাবে?
১। ইন্ডাস্ট্রি অনুযায়ী প্রতিযোগিতামূলক বেতনাদি প্রস্তাব করুন
চাকরি খোঁজার সময় সাধারণত যে জিনিসটাকে মানুষ সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয় তা হচ্ছে আশানুরূপ বেতন। আমরা সবাই চাই কাজের বিনিময়ে আমাদেরকে যথেষ্ট পারিশ্রমিক দেওয়া হোক। একই ধরনের আরেকটি পজিশনের চেয়ে আপনার কোম্পানিতে বেতন কম হলে একজন প্রতিভাবান চাকরিজীবীর আপনার কোম্পানিতে আগ্রহী হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। তাই উপযুক্ত চাকরিজীবী পেতে ও ধরে রাখতে বেতনের ব্যাপারে কার্পণ্য না করাই ভালো।
২। অন্যান্য সুবিধা সম্পর্কেও জানিয়ে দিন
আপনার কোম্পানি যদি এমপ্লয়িদেরকে ভালো সুযোগ-সুবিধা দেয়, তাহলে প্রতিভাবান কর্মজীবী নিয়োগ দেওয়া আপনার জন্য অনেকটা সহজ হয়ে আসবে। হেলথ ইন্স্যুরেন্স বা রিটায়ারমেন্ট প্ল্যান থেকে শুরু করে রিমোট বা ফ্লেক্সিবল সময় অনুযায়ী কাজ করার সুবিধা – এ সব কিছুই উপযুক্ত কর্মজীবী নিয়োগের চেষ্টায় আপনাকে বিশেষ সুবিধা দেবে।
৩। ‘টার্গেটেড’ বিজ্ঞাপন ব্যবহার করুন
চাকরির বিজ্ঞপ্তি সাধারণত যারা বেকারত্ব বা কর্মহীনতার কারণে চাকরি খুঁজছেন তাদেরকেই আকর্ষণ করে। পছন্দসই এবং উপযুক্ত কর্মজীবী পেতে চাইলে তাই এমন জায়গায় চাকরির বিজ্ঞাপনগুলো দিন যেখানে আপনার টার্গেটেড মানুষদের পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
যেমন ধরুন একজন উপযুক্ত সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার খুঁজে পেতে ফেসবুকে ইঞ্জিনিয়ারদের বড় কোনো গ্রুপে বিজ্ঞাপন দিতে পারেন। অথবা নিজের ইন্ডাস্ট্রির চেনা-জানা মানুষদের কাছে খবর পৌঁছে দিতে নিজের কোম্পানির পেইজের পাশাপাশি নিজের লিংকডইন প্রোফাইল থেকে শেয়ার করতে পারেন। এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা হচ্ছে আপনার আদর্শ এমপ্লয়ি কে এবং তাকে কোথায় খুঁজে পাওয়া সম্ভব তা বোঝার চেষ্টা করা।
নিয়োগ দেওয়া তো হয়ে গেল। এবার প্রশ্ন হচ্ছে, এই নিয়োগকৃত কর্মজীবীদেরকে দীর্ঘদিন চাকরিতে ধরে রাখবেন কীভাবে?
১। ব্যবস্থাপনা প্রশিক্ষণ আয়োজন করুন
কোম্পানির এমপ্লয়িদের ম্যানেজ করার ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনা পর্যায়ে যারা কাজ করেন তাঁদের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আপনার কোম্পানির ব্যবস্থাপনায় যদি পর্যাপ্ত যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি না থাকেন তাহলে কর্মজীবীদের চাকরিতে টিকিয়ে রাখা অনেকটাই কঠিন হয়ে যাবে। ব্যবস্থাপক ও পরিচালকদের যাতে কাজ করার জন্য প্রয়োজনীয় টুলস ও দক্ষতা থাকে তার জন্য নিয়মিত ব্যবস্থাপনা প্রশিক্ষণের আয়োজন করা গুরুত্বপূর্ণ।
২। কর্মজীবীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করুন
কোম্পানির কর্মজীবীরা যখন বিভিন্ন ইভেন্টে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করবেন, তখন তাঁদের কোম্পানির খারাপ সময়েও চাকরিতে টিকে থাকা এবং কোম্পানির উন্নয়নের জন্য উৎসাহের সাথে কাজ করার সম্ভাবনা বেশি থাকবে। আর কাজের প্রতি আগ্রহ মানেই ভালো পারফরমেন্স।
কোম্পানি আয়োজিত ইভেন্টে অংশগ্রহণ সবার জন্য বাধ্যতামূলক করা বা অংশগ্রহণকারীদের বিশেষ সুবিধা দেওয়ার মাধ্যমে কর্মজীবীদের সক্রিয়তা নিশ্চিত করা সম্ভব।
৩। যত দ্রুত সম্ভব সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করুন
যে কোনো সমস্যা বড় রূপ ধারণ করার আগেই তা নিয়ে অন্তত চিন্তা ভাবনা শুরু করা উচিত। কারণ সমস্যা যত নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাবে তত বেশি মানুষকে প্রভাবিত করবে।
আপনার হয়তো প্রতিদিন অনেক বিষয় নিয়ে চিন্তা করতে হয়, অনেক সমস্যার সমাধান করতে হয়। ছোটখাট কিছু সমস্যার কথা হঠাৎ ভুলে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। তাই যে কোনো সমস্যার কথা শোনার সাথে সাথেই অন্তত তার ব্যাপারে কিছু একটা পদক্ষেপ নিন এবং সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে তা অফিসের সবাইকে জানিয়ে দিন। এতে করে এমপ্লয়িরা বুঝতে পারবেন যে আপনিও তাঁদের পক্ষেরই একজন।
৪। দক্ষতা বৃদ্ধি ও অগ্রগতির পরিবেশ তৈরি করুন
এমপ্লয়িদের কোম্পানিতে ধরে রাখার একটি অন্যতম পন্থা হচ্ছে তাদেরকে কর্মজীবনে অগ্রগতির সুযোগ দেওয়া। নতুন কিছু শিখে হোক বা আগের অর্জিত দক্ষতাকে শাণিত করে, কোম্পানিতে তারা অনন্য ভূমিকা রাখতে পারছেন এটা নিশ্চিত করার চেষ্টা করুন।
প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্টে কাজ করা থেকে শুরু করে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পর্যন্ত নানাভাবে তাদের জন্য অগ্রগতির পরিবেশ তৈরি করে কোম্পানিতে দীর্ঘদিন কাজ চালিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ানো যায়।
৫। এমপ্লয়িদের মধ্যে একটি কার্যকর বিভিন্নতা তৈরি করুন
একটি কোম্পানিতে বিভিন্ন ধরনের দক্ষতা সম্পন্ন মানুষ কাজ করবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দক্ষতার মতো সহকর্মীদের ব্যক্তিত্বেও বিভিন্নতা থাকা উচিত।
অফিসের অধিকাংশ কর্মী যদি অনুপ্রেরণার অভাবে ভোগেন তাহলে কাজের গতি কমে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক। তাই এমনও কিছু কর্মী থাকা উচিত যারা কাজ করতে আগ্রহী এবং সহজে উৎসাহ হারায় না।
টিম যদি ছোট হয় এবং সবারই দীর্ঘদিন ধরে একসাথে কাজ করতে করতে অভ্যাস হয়ে গিয়ে থাকে, অনেক সময় এটাও একটা সমস্যা তৈরি করতে পারে। নতুন এবং পুরাতন কর্মীদের একটি মিশ্রণ তৈরি করার চেষ্টা করুন যাতে সিনিয়রদের কাছ থেকে উদ্দীপনাময় নতুন চাকরিজীবীরা কাজ শেখার মাধ্যমে ভবিষ্যতে আপনার কোম্পানির গুরুত্বপূর্ণ কর্মীতে পরিণত হয়।
৬। উপযুক্ত পথিকৃৎ তৈরি করুন
কর্মীদের যদি অনুপ্রাণিত রাখতে চান তার অন্যতম একটি উপায় হচ্ছে তাদের সামনে সঠিক উদাহরণ গড়ে তোলা। এতে করে অফিসের সবার মনোবল আরও দৃঢ় হবে।
উপযুক্ত পথিকৃৎ তৈরি করতে পারলেই কোম্পানির চাকরিজীবীদের পক্ষে কোম্পানি নিয়ে আপনার ভিশনকে বোঝা ও সে অনুযায়ী কাজ করা সম্ভব হবে।
‘এমপ্লয়ি রিটেনশন’ জিনিসটার শুরুই হয় আসলে কোনো পদের জন্য উপযুক্ত ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়ার মাধ্যমে। সর্বোচ্চ প্রতিভাবান চাকরিজীবীদের নিয়োগ দিতে ও কোম্পানিতে ধরে রাখতে চাইলে শুরুটা করতে হবে কোম্পানির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ সঠিক কর্মজীবী সন্ধান এবং অংশগ্রহণমূলক অফিস পরিবেশ তৈরির মাধ্যমে, যেখানে কর্মীরাও সাফল্য এবং অর্জনের অনুভূতি পাবে।
আশা করি উপরের টিপসগুলো কর্মী নিয়োগ ও ধরে রাখার ক্ষেত্রে আপনাকে সহায়তা করবে যাতে আপনার কোম্পানির ভিত্তি আরও মজবুত হয়ে ওঠে।