চিকিৎসক হওয়ার সিদ্ধান্ত কোনো ছোটখাট সিদ্ধান্ত নয়। এক তো মেডিকেল কলেজগুলোতে চান্স পেতে অনেক প্রস্তুতি আর অনেক বেশি পরিশ্রম করতেই হয়। ভর্তি হয়ে যাওয়ার পরেও আপনার জীবনের অন্যতম কিছু সময় প্রচণ্ড চাপের মধ্যে কাটাতে হবে। পরিশ্রম করার এবং মানসিক চাপ সহ্য করতে পারার মতো মানসিকতা যাদের নেই, এই পেশা তাদের জন্য না।
তবে আপনি যদি এই চাপের সাথে মানিয়ে নিতে পারেন তাহলে এই পেশাই আপনার জন্য অনেক আনন্দদায়ক হতে পারে। আর্থিক দিক থেকে তো আছেই, মানসিক দিক থেকেও। কারণ এই পেশায় আপনার দায়িত্বই হচ্ছে স্বাস্থ্যহীন মানুষকে সাহায্য করে তাদের সুস্থ করে তোলা।
কিন্তু সফল চিকিৎসক হতে আপনার কী কী স্কিল থাকা চাই? কোন জিনিসগুলোর দিকে বিশেষভাবে জোর দিয়ে আগে থেকেই নিজেকে প্রস্তুত রাখবেন? আমরা এমনই ১০টি স্কিলের তালিকা তৈরি করেছি আজ। কারণ আর সব পেশার মতোই একজন চিকিৎসকেরও কিছু মানবিক দক্ষতা থাকা অত্যন্ত জরুরি।
তাহলে আর দেরি না করে চলুন জেনে নেই সেই ১০টি স্কিল কী এবং আপনার কেনো এগুলো প্রয়োজন!
১। যোগাযোগ দক্ষতা
পেশা আপনার যাই হোক, এমনকি ছাত্র অবস্থাতেও, সঠিক যোগাযোগ রক্ষা করতে পারা একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতা। কিন্তু চিকিৎসাক্ষেত্রে এর প্রয়োজনটা একটু বেশিই।
আপনার দৈনন্দিন কাজের সবচেয়ে বড় অংশ জুড়ে থাকবে রোগীদের সাথে কথা বলে তাদের সমস্যা কী তা বোঝা এবং সেই অনুযায়ী সমাধানটাও তাদেরকে সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দেওয়া। আপনার যোগাযোগের ক্ষমতা যদি ভালো না থাকে তাহলে তাতে শুধু আপনার কাজই কঠিন হবে না, রোগীর জীবনের জন্যেও তা ঝুঁকিপূর্ণ।
বিশেষ করে প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে যোগাযোগ আপনার অনেক কাজে লাগবে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার আগেই রোগীর সমস্যা সম্পর্কে আপনার মোটামুটি একটা ধারণা থাকতে হবে। আর তার জন্য আপনি কোন প্রশ্নগুলো করছেন, রোগী আপনার সাথে স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে কথা বলছে কিনা, আপনি তাকে নিজের প্রশ্ন বোঝাতে পারছেন কিনা এবং রোগী যা সম্পূর্ণভাবে ব্যাখ্যা করতে পারছে না তা আপনি বুঝে নিতে পারছেন কিনা – এই বিষয়গুলোর ওপরেই নির্ভর করবে যে আপনার রোগ নির্ণয় কতোটা কার্যকরী। অপরদিকে, চিকিৎসক হিসেবে নার্স, টেকনিশিয়ান এবং চিকিৎসাসেবার সাথে জড়িত অন্যান্য প্রফেশনালদেরকেও আপনার পরিষ্কারভাবে নির্দেশনা দিতে হবে।
আপনি অ্যাকাডেমিক দিক থেকে যতোই সফল হন না কেনো, যোগাযোগের ব্যাপারে দক্ষ না হলে আপনার নিজের এবং রোগীদের তখন নানান রকম সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে।
২। সহানুভূতিশীলতা
একইভাবে, রোগীদের প্রতি সহানুভূতি ধরে রাখতে পারাও একটি গুরুত্বপূর্ণ স্কিল।
কঠিন বাস্তবতা হচ্ছে মাঝে মাঝেই আপনাকে রোগী বা তার আত্মীয়স্বজনদের খারাপ খবর দিতে হবে। যার ফলে আপনাকে এমন অনেক পরিস্থিতিতে পড়তে হতে পারে যেখানে রোগী ও তার পরিবার অনেকটা নেতিবাচকভাবে খবরটা গ্রহণ করছে। এরকম সময়ে তাদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করা এবং ঠাণ্ডা মাথায় পরিস্থিতি সামাল দেওয়া পরিস্থিতিকে আরও খারাপের দিকে যাওয়া থেকে বাঁচাতে পারে।
আপনার ক্যারিয়ারে এমন সময় আসবে যখন আপনার সম্পূর্ণ অপরিচিত একজন ব্যক্তিকে তার বাবার দুর্ঘটনায় আহত হওয়ার খবর দিতে হবে। এই কথোপকথনগুলো অনেক কষ্টদায়ক এবং অবশ্যই সহানুভূতি ও বিচক্ষণতার সাথে সামাল দিতে হবে।
৩। সমস্যা সমাধান করার ক্ষমতা
চিকিৎসকদের কাজটা অনেকটা গোয়েন্দাদের মতো। প্রথমে আপনি রোগীর থেকে বিভিন্ন সূত্র সন্ধান করবেন, তারপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রমাণ সংগ্রহ করবেন। এরপর যুক্তি ও আপনার জ্ঞানের ভিত্তিতে একটি কারণ ও সম্ভাব্য সমাধান দাঁড় করাবেন। অর্থাৎ, সমস্যা সমাধান করা আপনার কাজের একটা বিরাট অংশ।
রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা দেওয়ার জন্য টেকনিক্যাল যা জ্ঞান প্রয়োজন তা পড়াশোনার অভিজ্ঞতা থেকেই আপনি পেয়ে যাবেন। কিন্তু সেই জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে যৌক্তিকভাবে একটা সমাধান দাঁড় করাতে পারা শুধুমাত্র অভিজ্ঞতা ও প্র্যাকটিস থেকেই শেখা সম্ভব।
সব রোগ হয়তো শুরুতেই বোঝা যাবে না। অনেক সময় টেস্টের ফলাফলও পরিষ্কার কিছু নির্দেশ করবে না। কিন্তু রোগীকে সাহায্য করতে হলে আপনাকে বিভিন্ন দিক থেকে সব রকমের সম্ভাবনার কথা চিন্তা করে সঠিক সিদ্ধান্তটি নিতে হবে।
৪। মনোযোগ
ওষুধের ডোজ নির্ধারণ, রোগীর আগে কোনো সমস্যা ছিল কিনা, অ্যালার্জির সমস্যা আছে কিনা, ভৌগোলিক ও সামাজিক ভেদাভেদ – চিকিৎসাক্ষেত্রে কাজ করতে গিয়ে এরকম অনেক বড়-ছোট সূক্ষ্ম বিষয়ের দিকে লক্ষ্য রাখতে হয়। তাই একজন চিকিৎসকের জন্য মনোযোগের সাথে কাজ করা অত্যাবশ্যকই বলা যায়। আপনার মনোযোগের একটু এদিক-ওদিকের ওপর নির্ভর করতে পারে একজন ব্যক্তির স্বাস্থ্য।
শুধু ওষুধের ব্যাপারে লক্ষ্য রাখাই নয়, আপনাকে সব ধরনের ব্যাপার এখানে খেয়াল করতে হবে। একই রোগীকে যদি কয়েক দিন পর পরই আঘাত পেতে দেখা যায়, তার পেছনে খামখেয়ালী ছাড়া অন্য কোনো কারণও থাকতে পারে। একজন ভালো চিকিৎসক এই সবকিছুই খেয়াল করেন এবং রোগীকে সাহায্য করার জন্য কোনো প্রচেষ্টা বাকি রাখেন না।
৫। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা
রোগীর চিকিৎসার ব্যাপারে বেশিরভাগ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হয় ডাক্তারকেই। তাই আপনার দায়িত্বের সাথে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে সবসময় প্রস্তুত থাকতে হবে। এর মানে হচ্ছে রোগীদের চিকিৎসা পরিকল্পনা তত্ত্বাবধান করা এবং তা রোগীর আত্মীয়স্বজনকেও বুঝিয়েও দেওয়া। বিশেষ করে তারা যদি আপনার মতামতের সাথে একমত না হয়, আপনার কাজ আরও বেশি কঠিন হয়ে যাবে।
তার ওপর দিয়ে আপনি যখন ইমার্জেন্সিতে কাজ করবেন, তখন আপনাকে মুহূর্তের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতে হবে। ইমার্জেন্সি ইউনিটে সাধারণত এমন অনেক রোগী আসে যাদের দ্রুত চিকিৎসার প্রয়োজন থাকে। এই পরিস্থিতিতে শান্ত থেকে দ্রুততার সাথে সঠিক সমাধান দিতে পারা একজন ভালো চিকিৎসকের লক্ষণ।
৬। পেশাদারি মনোভাব
অনেক মানুষের সাথে কাজ করা খুব স্বাভাবিক পরিস্থিতিতেও অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে। কিন্তু তারা যখন অসুস্থ এবং মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকে তখন তাদেরকে সামলানো আরও শতগুণে বেশি কঠিন। সকল পরিস্থিতিতে নিজের পেশাদারিত্ব ধরে রাখতে পারা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পরিস্থিতির শিকার হয়ে এমন কিছু কখনোই করা যাবে না যাতে রোগীর চিকিৎসায় ব্যাঘাত ঘটে।
নিজের প্রফেশনালিজম ধরে রাখতে কয়েকটি বিষয় সবসময় খেয়াল রাখতে হবে –
• রোগী যে সামাজিক পরিস্থিতি থেকেই আসুক না কেনো, সবার প্রতি সম্মান প্রদর্শন।
• কোনো রোগী তার সমস্যা নিয়ে কথা বলতে লজ্জাবোধ করলে তাকে স্বতঃস্ফূর্ত হতে সাহায্য করা।
• সহনশীলতা ও সহানুভূতির সাথে রোগীদের সাথে কথা বলা।
৭। টিমের সাথে কাজ করতে পারা
যে কোনো চিকিৎসকের জন্যই একটি টিমের অংশ হিসেবে কাজ করতে পারা একটি গুরুত্বপূর্ণ স্কিল। আপনাকে অনেক সময় বড় কোনো সমস্যা সমাধানের জন্য ছোট বিশেষায়িত টিমের সদস্য হিসেবে কাজ করতে হতে পারে। আর তাছাড়া চিকিৎসা সেবায় কাজ করার কারণে প্রায়ই অন্যান্য বিশেষজ্ঞ ও পেশাজীবীদের কাছ থেকে আপনাকে মতামত নিতে হবে।
এইসব কারণে সহকর্মী ও অন্য চিকিৎসকদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন ও রক্ষা করতে পারা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটা চিকিৎসা প্রদানে যেমন সাহায্য করবে তেমনি আপনাকে কর্মক্ষেত্রে সুন্দর পরিবেশ বজায় রাখার ক্ষেত্রেও ফলপ্রসূ হবে।
৮। নেতৃত্ব
এমন একটা সময় আসবে যখন আপনি একজন সিনিয়র চিকিৎসক হবেন এবং আপনার ডিপার্টমেন্টের অন্যান্য সহকর্মীরা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ও জটিল সমস্যার সমাধানের জন্য আপনার কাছেই আসবে। অর্থাৎ, আপনাকে তাঁদের নেতৃত্ব দিতে হবে।
এছাড়া জুনিয়র চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া ও মেন্টরিং করাও হবে আপনার কাজের একটি অংশ। তার আপনার নেতৃত্ব দিতে পারার ক্ষমতা থাকা অবশ্যই জরুরি। এর মানে শুধু জুনিয়রদের জ্ঞান দেওয়া না। আপনার কাজ, সিদ্ধান্ত ও আচরণ থেকেও তাঁরা শিক্ষা নেবেন। তাই তাঁদের জন্য যোগ্য উদাহরণ তৈরি করা এবং প্রয়োজনে তাঁদের পাশে থেকে দেখিয়ে দেওয়া একজন ভালো চিকিৎসকের অন্যতম গুণ।
৯। সহনশীলতা
সহনশীলতাকে আসলে দক্ষতা বলা যায় না। বরং এটা একটা গুণ। কিন্তু তার মানে এটা না যে চেষ্টা এবং প্র্যাকটিসের মাধ্যমে সহনশীলতা বাড়ানো যায় না।
চিকিৎসকদেরকে প্রায়ই নেতিবাচক পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। অনেকেই আপনার মতামতকে গুরুত্ব দেবে না, কটাক্ষ করবে। আবার অনেকেই আপনাকে সম্পূর্ণ সহায়তা দেবে। বাস্তবতা হচ্ছে প্রতিটি মানুষই কঠিন তার আবেগ ভিন্নভাবে প্রকাশ করে। সহজে মন খারাপ হয়ে যাওয়া বা কষ্ট পাওয়া কোনো খারাপ জিনিস নয়। এর মানে হয়তো আপনি অনেক বেশি সহানুভূতিশীল। কিন্তু এই অনুভূতিগুলোকে সামলাতে পারা একটি বড় দক্ষতা। আপনার আবেগ যেন আপনার কাজের ওপর খারাপ প্রভাব না ফেলতে পারে।
১০। শেখার ইচ্ছা
চিকিৎসকের জীবনে জ্ঞান অর্জন কখনো শেষ হয় না। কারণ মানুষের দেহ এতোটাই জটিল, যে এর ব্যাপারে সবকিছু জানা একজন ব্যক্তির পক্ষে অসম্ভব। আর প্রতিনিয়তই নতুন নতুন গবেষণা, নতুন চিকিৎসা পদ্ধতির আবিষ্কার হয়েই চলছে।
তাই আজ থেকে ১০-১৫ বা আরও অনেক বছর পরেও আপনাকে পড়াশোনা চালিয়েই যেতে হবে। হয়তো নতুন ডিগ্রি অর্জন করতে হবে, নতুন রিসার্চ পড়তে হবে। সারা জীবন ধরে চলতে থাকা এই শিক্ষার জন্য দরকার অনেক ধৈর্য্য এবং শেখার ইচ্ছা। যা একজন চিকিৎসকের সাফল্যের জন্য অত্যাবশ্যক।
চিকিৎসক হওয়া কোনো সহজ কাজ নয়। বছরের পর বছর কঠোর পরিশ্রম করে তবেই একজন ব্যক্তি চিকিৎসক হিসেবে পরিচিতি দিতে পারেন। এই কঠিন প্রক্রিয়ার মাঝে অনেক সময়ই এই মানবিক দক্ষতাগুলো বাদ পড়ে যায়। কিন্তু অনেক সময় মানবিক গুণাবলীই হয় সাফল্য আর ব্যর্থতার মাঝে পার্থক্য নির্ধারক।