চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়াতে কার্যকরী কভার লেটার তৈরির কিছু টিপস

May 10, 2021 |
Views: 746

অনেকের মধ্যেই আজকাল একটা ধারণা দেখা যায় যে কভার লেটার তেমন একটা গুরুত্বপূর্ণ না, অথবা হায়ারিং ম্যানেজাররা কখনো কভার লেটার পড়েন না। কিন্তু বাস্তবতা অনেক সময়েই ভিন্ন। সিভির সাথে পাঠানো কভার লেটার অথবা ইমেইলটি চাকরিদাতার উপর আপনার প্রথম প্রভাব কেমন হবে তা নির্ধারণ করে। একটি গোছানো ও পরিষ্কার কভার লেটার সিভি দেখার আগেই চাকরিদাতার মনে আপনাকে অন্যদের থেকে এগিয়ে রাখতে পারে।

কিন্তু, এই বাড়তি সুবিধাটা পেতে হলে আপনাকে কভার লেটার লেখার কিছু নিয়ম ও কায়দা অবশ্যই জানতে হবে। তাহলে চলুন, কভার লেটার লেখার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রত্যেকটি ধাপ ও সেই ধাপের করণীয়গুলো জেনে নেওয়া যাক।

ধাপ ১ঃ শিরোনাম

কভার লেটার পাঠানোর সবচেয়ে বেশি প্রচলিত পদ্ধতি বর্তমানে ইমেইল। আপনি যদি ইমেইলে কভার লেটারটি পাঠান, তাহলে কোনো হেডার বা শিরোনামের প্রয়োজন নেই। সরাসরি ধাপ ৩ থেকে শুরু করুন।

তবে সাধারণভাবে প্রচলিত কভার লেটারের শিরোনাম এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলোর একটি। কারণ এটাই চাকরিদাতার সর্বপ্রথম চোখে পড়বে এবং এখানে ভুল করে ফেললে শুরু থেকেই আপনাকে নিয়ে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হবে।

তাহলে কভার লেটারের শিরোনামে কী কী থাকবে?

প্রথমেই আসবে আপনার যোগাযোগ সংক্রান্ত তথ্য, বিশেষ করে –

আপনার নাম
আপনার ফোন নম্বর
আপনার ইমেইল অ্যাড্রেস
আপনার সংক্ষিপ্ত ঠিকানা (এক্ষেত্রে শুধু থানা ও জেলার নাম ব্যবহার করাই যথেষ্ট)

পাশাপাশি আপনি আরও কিছু তথ্য এখানে যোগ করতে পারেন –

আপনার প্রফেশনাল টাইটেল
লিঙ্কডইন প্রোফাইলের URL
অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়ার URL
আপনার প্রফেশনাল ওয়েবসাইট অথবা পোর্টফোলিও-এর লিঙ্ক

শিরোনামের অবস্থান হবে কাগজের একেবারে উপরে। মাঝে, ডানে বা বামে – আপনার পছন্দমতো যে কোনো দিকে অ্যালাইন করতে পারেন। তবে চেষ্টা করুন সিভির সাথে যতোটা সম্ভব মিল রাখতে, যাতে আপনার নিজস্ব সব ডকুমেন্টে একটা ধারাবাহিকতা বজায় থাকে।

ধাপ ২ঃ তারিখ ও প্রাপকের ঠিকানা

ধাপ ১-এর মতো এই অংশটিও ইমেইলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কিন্তু ট্রেডিশনাল কভার লেটারে এটি অবশ্যই থাকতে হবে।

আপনার কভার লেটারের উপযুক্ত শিরোনাম নির্ধারণ হয়ে গিয়ে থাকলে এবার মূল অংশ লেখা শুরু করে দিন। মূল লেটারটা সাধারণত শুরু করা হয় তারিখ ও যার উদ্দেশ্যে লিখছেন তাঁর নাম-ঠিকানা দিয়ে। এ অংশে থাকবে –

আজকের তারিখ
হায়ারিং ম্যানেজারের নাম ও তাঁর প্রফেশনাল টাইটেল
যে কোম্পানিতে আবেদন করছেন তার নাম ও ঠিকানা

এই অংশটি সাধারণত কাগজের বাম দিকে অ্যালাইন করা হয়।

তারিখ লেখার সময়ে ফরমেটের দিকে বিশেষ খেয়াল রাখুন। মাসের নাম ছোট করে লেখা বা শুধু নম্বর ব্যবহার করে তারিখ লেখা সাধারণত ফরমাল ডকুমেন্টে গ্রহণযোগ্য নয়। তারিখের ফরমেট হিসেবে “February 23, 2021” বেশি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তবে দেশের বাইরের কোনো সংস্থায় আবেদন করতে গেলে সেই দেশের প্রচলিত রীতি অনুযায়ী তারিখের ফরমেট পরিবর্তন করতে পারেন। শুধু লক্ষ্য রাখবেন আপনার ফরমেটটি যেন ফরমাল হয়।

হায়ারিং ম্যানেজারের নাম ও টাইটেল বেশিরভাগ সময়ই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ থাকে। যদি সেখান থেকে খুঁজে না পাওয়া যায়, সেক্ষেত্রে কোম্পানির ওয়েবসাইট ঘেঁটে অথবা সরাসরি যোগাযোগ করার মাধ্যমেও এই সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করতে পারেন। এতে ভয় অথবা সংশয়ের কোনো কিছু নেই, সক্রিয়ভাবে আগ্রহ প্রকাশ করা বরং চাকরিদাতার কাছে প্রশংসিতই হবে।

ধাপ ৩ঃ প্রফেশনাল সম্বোধন

ইমেইলের মাধ্যমে পাঠানো কভার লেটারের ক্ষেত্রে এটিই আপনার প্রথম ধাপ। কভার লেটারটি কার উদ্দেশ্যে লিখছেন? তাঁকে এই অংশে সরাসরি সম্বোধন করুন।

আন্তর্জাতিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে সাধারণত এখানে নিয়োগের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তির নাম উল্লেখ করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশীয় সংস্কৃতি অনুযায়ী তা সবসময় গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু তাই বলে শুধু স্যার/ম্যা’ম হিসেবে সম্বোধন করা অব্যক্তিক এবং খানিকটা সেকেলে। তার বদলে প্রাপকের প্রফেশনাল টাইটেল উল্লেখ করে সম্বোধন করতে পারেন।

Dear Hiring Manager,

Dear HR Manager,

Dear [Department] HR Manager,

এই সবগুলোই গ্রহণযোগ্য সম্বোধন যা আপনার কভার লেটারকে আধুনিক ও ভিন্নধর্মী একটা স্পর্শ দেবে। আর সরাসরি নাম উল্লেখ করে সম্বোধন করতে চাইলে নামের আগে Mr/Ms. লিখতে ভুলবেন না।

ধাপ ৪ঃ প্রারম্ভিক প্যারা

হায়ারিং ম্যানেজাররা প্রায় প্রতিদিনই একাধিক কভার লেটার পড়ে থাকেন, তাই আর সবার মতো একইরকম গৎবাঁধাভাবে লেখা কভার লেটার তাঁদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারে না। মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাইলে তাঁর কোম্পানিতে চাকরি করার ব্যাপারে আপনার আগ্রহ ও উৎসাহ তুলে ধরুন প্রথম কয়েকটা লাইনের মধ্যে।

কভার লেটারের শুরুটা হওয়া চাই আপনার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং সৃজনশীল। ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করা কোনো টেম্পলেট অক্ষরে অক্ষরে অনুসরণ না করে, বরং সেটা আপনার ব্যক্তিত্ব অনুযায়ী পরিবর্তন করে নিন।

নিজের জীবনের কোনো ঘটনা বা সাম্প্রতিক নতুন কোনো খবর দিয়ে শুরু করতে পারেন। অবশ্যই, তা আপনার আবেদনের সাথে সম্পর্কিত হতে হবে। অথবা এই কোম্পানি সম্পর্কে কীভাবে জানলেন এবং কেনো এই চাকরিতে আবেদন করার সিদ্ধান্ত নিলেন তার সংক্ষিপ্ত বর্ণনাও আপনার কভার লেটারকে দিতে পারে একটি আকর্ষণীয় আরম্ভ।

ধাপ ৫ঃ দ্বিতীয় প্যারা

বেশিরভাগ কভার লেটারে এই অংশের শুরুটা হয় অনেকটা এমন, “I am looking for an opportunity to apply and grow my skills.” কভার লেটার লেখার সবচেয়ে বড় ভুল এটা।

চাকরিটি থেকে আপনি কীভাবে লাভবান হবেন তার চেয়ে কোম্পানি কীভাবে লাভবান হবে সেটা তুলে ধরা এখানে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কভার লেটারের দ্বিতীয় প্যাড়ার মূল উদ্দেশ্য কোম্পানিকে আপনি কী কী উপায়ে সাহায্য করতে পারেন তা উপস্থাপন করা।

কী লিখবেন তা সম্পররেক ধারণা পেতে চাকরির বিজ্ঞপ্তিটি আবার পড়ুন এবং সেখানে কী কী যোগ্যতা চাওয়া হচ্ছে তা নোট করে নিন। এই তালিকা থেকে এবার দু-তিনটি যোগ্যতা বেছে নিন যা নিয়ে আপনি লিখবেন। চেষ্টা করুন কাঙ্ক্ষিত পজিশনটির জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ স্কিলগুলোর দিকে আলোকপাত করতে।

এরপর কার্যকর উদাহরণ ও বাস্তব অভিজ্ঞতার বর্ণনা দেওয়ার মাধ্যমে আপনার যে এই যোগ্যতাগুলো আছে তা উপস্থাপন করুন কভার লেটারের দ্বিতীয় প্যারার মধ্য দিয়ে। প্রয়োজনে বুলেট পয়েন্টও ব্যবহার করতে পারেন।

ধাপ ৬ঃ তৃতীয় প্যারা

তৃতীয় প্যারার উদ্দেশ্য আপনি কেনো এই কোম্পানি বা এই পজিশনে কাজ করতে চান তা বর্ণনা করা। হয়তো আপনার এই চাকরিতে আবেদনের কারণ ভালো বেতন ও সুযোগ-সুবিধা। কিন্তু তার বাইরেও সব কোম্পানির কিছু বিশেষত্ব থাকে। এই অংশ লেখার সময় সেই অসাধারণ দিকগুলোতে জোর দিন।

এর জন্য অবশ্যই আপনাকে কিছু রিসার্চ করতে হবে। কোম্পানির ওয়েবসাইট ঘেঁটে তাদের বাণিজ্যিক লক্ষ্য ও অভ্যন্তরীণ সংস্কৃতি সম্পর্কে জানুন, গুগল সার্চ করে কোম্পানি নিয়ে পাবলিশ হওয়া প্রেস রিলিজ ও আর্টিকেল পড়ুন। এরপর তাদের মিশন কীভাবে আপনার ব্যক্তিত্ব ও আগ্রহের সাথে মিলে যায় তা বর্ণনা করুন। আপনি যে এই কোম্পানির লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে পরিশ্রম করতে ইচ্ছুক তা উপস্থাপন করাই এই অংশের উদ্দেশ্য।

ধাপ ৭ঃ শেষ প্যারা

এবার কভার লেটারটাকে শক্তিশালীভাবে শেষ করার পালা। কারণ হায়ারিং ম্যানেজারের ওপর একটি চমৎকার প্রভাব ফেলার এটাই আপনার শেষ সুযোগ। এই অংশে যে জিনিসগুলো অবশ্যই থাকতে হবে, তা হলো –

সময় নিয়ে আপনার আবেদনটি যাচাই করার জন্য হায়ারিং ম্যানেজারের প্রতি কৃতজ্ঞতা
কেনো আপনি এই চাকরির জন্য উপযুক্ত তার একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ
এই সুযোগ নিয়ে আপনার উত্তেজনা
ইন্টারভিউ দেওয়ার ব্যাপারে আপনার আগ্রহের বিনীত উল্লেখ

ধাপ ৮ঃ আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি

মূল লেখা তো হয়ে গেলো। এবার বাকি শুধু কভার লেটারটা ফরমালভাবে শেষ করা – একটি আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি, আর শেষে আপনার নাম ও সংক্ষিপ্ত পরিচয়।

এখানে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হওয়া সমাপ্তিগুলো হচ্ছে –

Best regards,

Kind regards,

Sincerely,

Thank you,

Thanks for your consideration,

With regards,

এরপর আপনার নাম টাইপ করুন এবং তার নিচে আপনার প্রফেশনাল টাইটেল, ফোন নম্বর ও ইমেইলের ঠিকানা জুড়ে দিন। বিশেষ করে ইমেইলের ক্ষেত্রে এই অংশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ সেখানে শিরোনামে ঠিকানা-পরিচয় উল্লেখ করা হয় নি। লেটার ও সিভি যদি ডাকের মাধ্যমে পাঠাতে চান, তাহলে কভার লেটার প্রিন্ট করার পর নিজ হাতে আপনার নাম স্বাক্ষর করতে ভুলবেন না।

ধাপ ৯ঃ পাদটীকা

কী ভাবছেন? ফরমাল ডকুমেন্টে আবার পাদটীকা ব্যবহার করবেন কেনো? কভার লেটারে পাদটীকার ব্যবহার সম্প্রতি বেশ জনপ্রিয়তা পাচ্ছে এবং এটা আপনার লেটারকে আর সবার থেকে আলাদা করে তুলতে পারে।

পাদটীকার ব্যবহার পাঠকের আকর্ষণ কেড়ে নিতে বাধ্য, কারণ খুব কম মানুষই এটা করে। হায়ারিং ম্যানেজারের কাছে আলাদাভাবে চোখে পড়ার পাশাপাশি লেটারের শেষ দুটো বাক্য হিসেবে এই পাদটীকা আপনার সম্পর্কে বিশেষ কোনো তথ্যের রেশ রেখে যাবে তাঁর মনে।

তবে মনে রাখবেন, এই অংশটি পুরোপুরিই ঐচ্ছিক। আপনি যদি পাদটীকা ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে তার লাইন দুটো হতে হবে গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রাসঙ্গিক। এমন কিছু যা চাকরিদাতা দীর্ঘ সময় মনে রাখবেন। অপ্রাসঙ্গিক বা অপ্রয়োজনীয় কিছু উল্লেখ করার জন্য পাদটীকা ব্যবহার হীতে বিপরীত ঘটাতে পারে।

আপাতদৃষ্টিতে কভার লেটার লেখাকে বেশ কঠিন ও সময়সাপেক্ষ কাজ বলে মনে হলেও ছোট ছোট ধাপে ভাগ করে নিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় লিখতে বসলে সহজেই একটি কার্যকরী কভার লেটার তৈরি করে ফেলা সম্ভব। মনে রাখবেন, আপনার কভার লেটারটি হওয়া চাই সংক্ষিপ্ত, যে চাকরির আবেদন করছেন তার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং আপনার অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতার প্রতিফলক।