বিদেশী কোম্পানির সাথে পার্টনারশিপ থেকে শুরু করে রিমোট এমপ্লয়ি নিয়োগ করা পর্যন্ত – বড় ছোট সব কোম্পানিই এখন নানান দেশের নানান সংস্কৃতির মানুষের সাথে কাজ করা শুরু করেছে। ফলস্বরূপ, আমাদের প্রায়ই ভিন্ন সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠা মানুষের সাথে পরিচিত হওয়ার সৌভাগ্য হচ্ছে, সুযোগ হচ্ছে তাঁদের জীবনযাত্রা ও রীতিনীতি সম্পর্কে জানার। যা একইসাথে বাড়াচ্ছে কোম্পানির লাভবান হওয়ার সম্ভাবনাও। আবার সম্পূর্ণ বাংলাদেশভিত্তিক কোম্পানিতেও দেশের বিভিন্ন অঞ্চল ও সাংস্কৃতিক পটভূমির মানুষের সাথে প্রতিদিন কাজ করতে হয়।
বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির সহকর্মীদের সাথে কাজ করাটা তখনই উপভোগ করা যাবে যখন তাঁদের সাথে যথাযথ যোগাযোগ বজায় রাখতে পারবেন। আর সেই কাজে সাহায্য করতেই আজ আমরা তৈরি করেছি এই ছোট্ট গাইডটি।
১। জানার ও শেখার পেছনে সময় দিন
আন্তর্জাতিক ক্লায়েন্ট ও ভিন্ন সংস্কৃতির সহকর্মীদের সাথে কথা বলতে গিয়ে শুরুতে সবাই একটু হলেও হিমশিম খায়। আর পাঁচটা প্রফেশনাল স্কিলের মতো এই স্কিলটাও সময় নিয়ে জ্ঞান অর্জন করার মাধ্যমেই শিখতে হয়।
– রিসার্চ করুন
টোকিও অফিসের এক্সিকিউটিভের সাথে মিটিং অথবা নরওয়ের পার্টনার কোম্পানি দেখতে যাওয়া – উদ্দেশ্য যাই হোক না কেনো, প্রস্তুতি নেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। মিটিং-এর জন্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহ করা যেমন দরকার, তেমনি প্রয়োজন যে দেশের মানুষের সাথে কথা বলবেন তাঁদের বাণিজ্যিক ও সামাজিক রীতিগুলো সম্পর্কেও জানা।
মৌখিকের পাশাপাশি বাহ্যিক যোগাযোগের দিকে নজর রাখাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শুভেচ্ছা বিনিময় বা হাত মেলানোর মতো স্বাভাবিক বিষয়গুলোও অনেক সংস্কৃতিতে ভিন্নভাবে করা হয়ে থাকে এবং এক্ষেত্রে ভুল করা মিটিং-এর শুরুতেই সবাইকে একটা অপ্রস্তুত অবস্থায় ফেলতে পারে।
– প্রশ্ন করুন
নিজের অজান্তে কারও সাথে অপমানজনক আচরণ করা থেকে বিরত থাকার সবচেয়ে সহজ ও কার্যকরী উপায় হচ্ছে যাদের সাথে কাজ করছেন তাঁদেরকেই প্রশ্ন করা। তবে যে কারও সংস্কৃতি সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন করার সময় অবশ্যই যথেষ্ট সম্মান ও আন্তরিকতার সাথে করতে হবে। কোনো বর্ণবাদী মন্তব্য বা ধারণা সম্পর্কে প্রশ্ন করা থেকে বিরত থাকুন।
কোনো ব্যক্তির সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে জানার ও বোঝার ইচ্ছা এটাই প্রমাণ করবে যে আপনি তাঁর মূল্যবোধকে যথার্থ গুরুত্ব দেন। পরবর্তীতে যদি আপনি কোনো ভুল করেও ফেলেন, আপনার এই আগ্রহ দেখানোর সুবাদে তা ব্যক্তিগতভাবে না নিয়ে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার সম্ভাবনাও বাড়বে।
– সহকর্মীদের আচরণের দিকে মনোযোগ দিন
পর্যবেক্ষণশীলতা এমন একটি পদ্ধতি যা অবলম্বন করে আপনি যেমন কর্মক্ষেত্রে হওয়া কোনো দ্বিমত সমাধান করতে পারবেন না, তেমনি তা এড়াতেও পারবেন। ভিন্ন সংস্কৃতির সহকর্মীদের সাথে কাজ করার সময় তাঁরা নিজেদের মধ্যে কীভাবে মত বিনিময় করছেন তা মনোযোগের সাথে লক্ষ্য করুন। তাঁরা কীভাবে সমস্যার সমাধান করেন এবং একে অপরকে সহযোগিতা করেন তা খেয়াল করুন। ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে তাঁদের প্রতিক্রিয়া কী হয় তা দেখুন। শুধু সংস্কৃতি বা আচরণের ভিন্নতা নয়, মিলের দিকেও নজর দিন। কারণ সেই মিলগুলোই আপনাকে তাঁদের সাথে কথা বলতে এবং সম্পর্ক গড়ে তুলতে সাহায্য করবে।
– তাদের ভাষা শিখুন
না, আপনার প্রত্যেক নতুন দেশ থেকে আসা সহকর্মীর জন্য একটা করে নতুন ভাষার কোর্সে ভর্তি হতে হবে না। ছোট ছোট কিছু বাক্য, শুভেচ্ছা বিনিময় বা ধন্যবাদ দেওয়া শেখার মাধ্যমে আপনি যে তাঁদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন তা বুঝিয়ে দেওয়া সম্ভব, যা তাঁদের সাথে ইতিবাচক সম্পর্ক স্থাপন করতে সাহায্য করবে।
তবে এই পর্যায়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে প্রত্যেক সহকর্মীর নামের সঠিক উচ্চারণ শেখা। ভাষা যতোই ভিন্ন হোক এবং উচ্চারণ যতোই কঠিন হোক, কাউকে ভুল নামে ডাকা ব্যক্তিগতভাবে বেদনাদায়ক একটি আচরণ। ধরুন আপনার নাম হাসান, কিন্তু প্রতিদিন আপনার একজন সহকর্মী আপনাকে মাসুদ বলে ডাকে। শুধুমাত্র বিদেশী ভাষায় হওয়ার কারণে কারও নাম প্রতিদিন ভুল উচ্চারণ করা একই পর্যায়ের অপমানজনক হতে পারে। প্রয়োজনে সহকর্মীকেই ভদ্রভাবে তাঁর নামের উচ্চারণ জিজ্ঞেস করুন। আপনার এই প্রচেষ্টায় তিনি বরং খুশিই হবেন।
২। নিজের আচরণের ব্যাপারে সচেতন হোন
আন্তঃসাংস্কৃতিক যোগাযোগে পারদর্শী হতে চাইলে শুধু সহকর্মীদের দিকে মনোযোগ দিলেই হবে না, নিজের আচরণের দিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। আমরা অনেক সময়ই নিজেদের অবচেতন মনে বেড়ে ওঠা পক্ষপাতিত্বগুলো সম্পর্কে সচেতন থাকি না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে আমরা যতোই পক্ষপাত থেকে দূরে থাকতে চাই না কেনো, নিজ সমাজ ও সংস্কৃতিতে প্রচলিত ধারণাগুলো অজান্তেই আমাদের মনে জায়গা করে নেয়। এবং বেশিরভাগ মানুষ কখনো নিজের আচরণে এই সমস্যাগুলো লক্ষ্যও করে না।
বিশিষ্ট গ্রন্থকার ডেবি নার্ভার প্রত্যেককেই তার নিজের নৃতাত্ত্বিকতা নিয়ে চিন্তা করার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, “যখন আমরা সক্রিয়ভাবে স্টেরিওটাইপ ও পক্ষপাতমুক্ত থাকার চেষ্টা করি, এমনকি তখনও আমাদের বিশেষ কোনো বিশ্বাস বা ধারণা অনুযায়ী আচরণ করার সম্ভাবনা থাকে। যা অচেতনভাবে আমাদেরকে কোনো নতুন ও ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গী মেনে নেওয়া থেকে বিরত করে।”
– নিজের ‘ধারণা’গুলো ঝেড়ে ফেলুন
ভিন্ন সংস্কৃতির সাথে সহজভাবে মানিয়ে নিতে পারার প্রথম ধাপ হচ্ছে সেই দেশ বা জাতি সম্পর্কে আপনার অযৌক্তিক ধারণাগুলো দূর করা। নতুন বিজনেস পার্টনার ফ্রান্সে থাকেন শুনেই কেনো ধরে নিলেন যে তিনি সহকর্মীদের সাথে নমনীয় আচরণ করবেন অথবা ফর্মাল পোশাক পরা পছন্দ করবেন? আপনি হয়তো এটা কখনো চিন্তাই করেন নি যে অন্য দেশের মানুষ সম্পর্কে আপনার ধারণাগুলোর বেশিরভাগই এসেছে অনির্ভরযোগ্য মাধ্যম থেকে।
যে দেশ বা যে সংস্কৃতিরই হোক না কেনো, প্রত্যেক ব্যক্তিই অন্য সবার থেকে আলাদা। আপনার প্রতিবেশী যেমন আপনার থেকে অনেক দিক দিয়ে ভিন্ন, একই দেশ থেকে আসা আপনার দুজন সহকর্মীও তেমনি একে অপর থেকে পুরোপুরি আলাদা।
– নিজেকে বড় মনে করা থেকে বিরত থাকুন
নিজের দেশ ও সংস্কৃতিকে সবাই অন্যদের চেয়ে বড় মনে করে। তবে দেশপ্রেম যেমন ভালো গুণ, অন্য দেশের সংস্কৃতিকে ভুল মনে করা বা ছোট করে দেখা তেমনই অনুচিত। যে কোনো বিদেশী বা ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের সাথে কথা বলার সময় অবশ্যই তাঁর সংস্কৃতিকে নিজের সংস্কৃতির মতোই সম্মানজনক মনে করতে হবে। নিজের রীতিনীতিকে শ্রেয় প্রমাণ করার চেষ্টা করবেন না।
– ভাষার দিকে খেয়াল রাখুন
বিদেশী সহকর্মীর সামনে নিজেদের মধ্যে বাংলায় কথা বলা বেমানান এবং এতে তাঁর বিরক্ত বোধ করার সম্ভাবনা অনেক। কারও সাথে বাংলায় কথা বলার প্রয়োজন হলে বিদেশী সহকর্মীর সাথে আলাপ শেষ করে এরপর আলাদাভাবে বলুন।
এমনকি আপনার সহকর্মী যদি বাংলা শিখেও থাকেন, এমন অনেক প্রচলিত ও আঞ্চলিক কথা আমরা দৈনন্দিন আলোচনায় ব্যবহার করি যা একজন বিদেশীর কাছে অপরিচিত ও অবোধগম্য হতে পারে। তাই অন্য সংস্কৃতির সহকর্মীদের খুশি রাখতে চাইলে আপনি যা বলছেন তা তাঁদের কাছে গ্রহণযোগ্য কিনা সেদিকে একটু লক্ষ্য রাখতে হবে।
বিশেষ করে বর্ণবাদ বা পক্ষপাতিত্ব উত্থাপন করতে পারে এমন কোনো প্রবাদ ব্যবহার করা থেকে সবসময় বিরত থাকুন।
৩। বিশেষজ্ঞদের সাহায্য নিন
ছোট-বড় অনেক কোম্পানিই এখন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অংশগ্রহণ করছে এবং নিয়মিত বিভিন্ন সংস্কৃতি থেকে আসা চাকরিজীবীও নিয়োগ দিচ্ছে। যদিও আন্তঃসাংস্কৃতিক যোগাযোগ শিখতে আপনি নিজে থেকে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিতে পারেন, অনেক সময় এ বিষয়ে অভিজ্ঞ কারও সাহায্য নেওয়া অনেক বেশি কার্যকর।
– প্রশিক্ষণ নেওয়ার কথা ভাবতে পারেন
অনেক কোম্পানি তাদের এমপ্লয়িদেরকে আন্তঃসাংস্কৃতিক ট্রেনিং-এর সুবিধা দিয়ে থাকে। কোন প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে সেই সিদ্ধান্তের দায়িত্বে যদি আপনি থাকেন, তাহলে শুধুমাত্র সাংস্কৃতিক শিষ্টাচার শেখায় এমন কোর্স বেছে না নিয়ে আরও বেশি কিছু খুঁজুন। যেমন, Berlitz-এ মানুষের কর্মক্ষত্রে প্রভাব ফেলে এমন ৬টি সাংস্কৃতিক পর্যায়ের ওপর বিশেষ ট্রেনিং দেওয়া হয়।
– সাংস্কৃতিকভাবে বৈচিত্র্যময় টিম তৈরি করুন
বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষ সিদ্ধান্ত নেওয়ায় অংশগ্রহণ করলে ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির কাজের ধরণের সাথে মানিয়ে নেওয়া সাধারণত সহজ হয়। অন্যদের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে জানা এবং মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া আন্তঃসাংস্কৃতিক যোগাযোগের পাশাপাশি টিমের সাথে কাজ করার স্কিলও বাড়াবে। হায়ারিং কমিটি হোক বা কোনো নতুন প্রজেক্ট পরিকল্পনার টিম – বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষ একসাথে মিলে সিদ্ধান্ত নিলে তা সাধারণত কোম্পানিকে উন্নতির দিকেই প্রভাবিত করে।
– সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করুন
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে এটা বিশ্বের যে কোনো জায়গার মানুষের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের খুব সহজ একটা উপায়। বিভিন্ন আগ্রহ-ভিত্তিক ফেসবুক গ্রুপ, ডিসকর্ড সার্ভার ও অনলাইন ফোরামে বিশ্বের প্রায় সব দেশ ও সংস্কৃতির মানুষ একত্র হয়ে তাদের সাধারণ আগ্রহের বিষয় নিয়ে কথাবার্তা বলে।
আপনার প্রিয় ভিডিও গেইম হোক বা নতুন বের হওয়া কোনো টিভি সিরিজ – একটু খুঁজলেই এই বিষয়ে কোনো না কোনো গ্রুপ বা ফোরাম পেয়ে যাবেন যেখানে আপনার বিভিন্ন দেশের মানুষের সাথে কথা বলার সুযোগ হবে। সাধারণ আগ্রহ থাকার কারণে এসব প্ল্যাটফর্মে বন্ধুত্ব গড়ে তোলার সুযোগ অনেক বেশি। যাতে করে আপনি তুলনামূলকভাবে সহজে সংস্কৃতি সম্পর্কিত প্রশ্ন করতে পারবেন, তাদের রীতিনীতি ও আচরণগত বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানতে পারবেন।
৪। যা শিখেছেন তা আচরণে প্রতিফলিত করুন
রিসার্চ করা, প্রশিক্ষণ নেওয়া, পর্যবেক্ষণশীল হওয়া – সবই ভিন্ন সংস্কৃতির সহকর্মীদের সাথে সঠিক যোগাযোগ রাখা শেখার পথে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। কিন্তু আপনার প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে এই সব জ্ঞানকে অভ্যাসে পরিণত করা। নিজের আচরণ ও কাজে অর্জিত জ্ঞানের প্রতিফলন ঘটাতে পারলেই শুধু সহকর্মীদের সাথে কার্যকর যোগাযোগ বজায় রাখা সম্ভব।
আশা করি এই আর্টিকেলটি আপনার সহকর্মীদের সাথে আরও ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলতে এবং কর্মক্ষেত্রকে আরও আনন্দদায়ক করতে সাহায্য করবে।