একজন সফল অ্যাকাউন্ট্যান্ট হওয়ার উপায়

January 26, 2021 |
Views: 931

অ্যাকাউন্ট্যান্ট হিসেবে ক্যারিয়ারকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ অনেক। যেখানেই টাকার লেনদেন, সেখানেই দরকার একজন অ্যাকাউন্ট্যান্ট। আর এই ক্যারিয়ারে সাফল্য – এনে দিতে পারে চমৎকার ফলাফল। কর্পোরেট ফিন্যান্সের এই আকর্ষণীয় জগৎ যদি হয় আপনার স্বপ্ন, তাহলে আর দেরি কেন? কীভাবে নিজেকে প্রস্তুত করবেন অ্যাকাউন্ট্যান্ট ক্যারিয়ারটির জন্য সেই সব তথ্য নিয়েই সাজানো আজকের আর্টিকেল।

১। প্রফেশনটি সম্পর্কে জানুন

আর পাঁচটা ক্যারিয়ারের মতোই এই ক্ষেত্রেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে যথেষ্ট রিসার্চ করা প্রয়োজন। এতে করে প্রফেশনটির ভালো-মন্দ যাচাই করে এটি আপনার জন্য সত্যিই সঠিক কিনা তা নির্ধারণ করতে পারবেন।

আধুনিক যুগে অ্যাকাউন্ট্যান্টদের কাজ বেশ জটিল এবং তাঁদেরকে অনেক দিকে খেয়াল রাখতে হয়। কিন্তু প্রধানত তাঁদের কাজ হচ্ছে কোম্পানি অথবা ব্যক্তির আর্থিক সকল বিষয় তদারকি করা। তাঁরা ব্যাংক অ্যাকাউন্টগুলোর হিসাব নিকাশ ও বিশ্লেষণ করেন এবং সংস্থার আর্থিক অবস্থার দিকে সূক্ষ্ম দৃষ্টি রাখেন। অ্যাকাউন্টিং-এর নীতি ও জটিল সব আর্থিক নিয়মের ব্যাপারে তাঁদের থাকে বিশেষ জ্ঞান।

অ্যাকাউন্ট্যান্ট হিসেবে অনেক ইন্ডাস্ট্রিতেই কাজ করা যায়। ছোট বড় সব ব্যবসায়, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থায়, এমনকি ব্যক্তি বিশেষের আর্থিক হিসাব নিকাশের জন্যও অ্যাকাউন্ট্যান্ট প্রয়োজন হয়। বেশিরভাগ প্রফেশনাল অ্যাকাউন্ট্যান্টরাই এ কারণে কোনো একটি সেক্টর বা ইন্ডাস্ট্রিকে বেছে নেন।

প্রত্যেক কোম্পানি বা ব্যক্তির চাহিদা ভিন্ন ভিন্ন হলেও, অ্যাকাউন্ট্যান্টদের সাধারণত যে দায়িত্বগুলো পালন করতে হয়, তা হলো –

আর্থিক পরামর্শ প্রদান করা
মাসিক, ত্রৈমাসিক ও বার্ষিক লেনদেনের স্টেটমেন্ট তৈরি করা
ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা ও ম্যানেজ করা
বাহ্যিকভাবে কোম্পানির আর্থিক অবস্থার হিসাবনিকাশ করা
অভ্যন্তরীণ হিসাবের ভিত্তিতে রিপোর্ট তৈরি করা ও পরামর্শ দেওয়া
ট্যাক্স ও লেজিস্লেশনের ব্যাপারে ক্লায়েন্টকে সাহায্য করা
বিভিন্ন বাণিজ্যিক লেনদেনের ব্যাপারে ক্লায়েন্টকে পরামর্শ দেওয়া
প্রতারণা ও অন্যান্য বেআইনি কাজ যাতে না হয় তা নিশ্চিত করা
আর্থিক প্রতারণার তদন্তে সাহায্য করা
– প্রয়োজনীয় যোগ্যতা

অ্যাকাউন্ট্যান্ট পদে চাকরি করতে চাইলে বেশ কিছু যোগ্যতা ও দক্ষতা থাকা আবশ্যক, যেমন –

সংখ্যাগত দক্ষতা – অ্যাকাউন্ট্যান্টদের চাকরিটাই এমন যে এর জন্য হিসাব-নিকাশে পারদর্শী হতে হয়। প্রথম চাকরির ইন্টারভিউ হিসেবে বেশি সম্ভব আপনাকে বেশ কিছু অঙ্ক কষার পরীক্ষা দিতে হবে। তাই নিজের সংখ্যাগত দক্ষতাকে ঝালাই করে নিতে ভুলবেন না।

সময়ানুবর্তিতা – এই প্রফেশনে সাধারণত খুব ব্যস্ত সময় কাটাতে হয়। তাই নিজের সময়কে ঠিকভাবে ম্যানেজ করতে পারা আর সময়মতো সব কাজ সম্পন্ন করতে পারা অ্যাকাউন্ট্যান্টদের জন্য একটি বড় গুণ।

যোগাযোগ দক্ষতা – অ্যাকাউন্ট্যান্ট হিসেবে প্রায়ই আপনাকে নিজের টিমের বাইরের অপরিচিত ও স্বল্পপরিচিত মানুষদের সাথে কাজ করতে হবে। কর্মক্ষেত্রে সবার সাথে যথাযথ যোগাযোগ বজায় রাখতে পারা কর্পোরেট জগতের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ।

মাইক্রোসফট এক্সেলের জ্ঞান – দৈনন্দিন কাজে অনেক রকম টুল ও সফটওয়্যার ব্যবহার করার দরকার হলেও অ্যাকাউন্ট্যান্টদের সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ও গুরুত্বপূর্ণ টুল হলো এক্সেল বা স্প্রেডশিট। জটিল হিসাব নিকাশ আর বিশাল সব স্প্রেডশিট তৈরি ও ম্যানেজ করা অনেকটাই সহজ হয়ে যাবে যদি আপনি সফটওয়্যারটার সাথে ভালোভাবে পরিচিত থাকেন।

বাণিজ্যিক ধারণা – ক্লায়েন্টের ব্যবসা ও ইন্ডাস্ট্রি সম্পর্কে পরিস্কার ধারণা না থাকলে অ্যাকাউন্ট্যান্ট হিসেবে সফল হওয়া অসম্ভব। তাই নতুন সব ট্রেন্ড সম্পর্কে সচেতন থাকা এবং ইন্ডাস্ট্রিতে কীভাবে সবকিছু চলে তা জানা আপনার ক্যারিয়ারে এগিয়ে যাওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।

খুঁতখুঁতে মনোভাব – খুব ছোট ছোট ভুলগুলোও হইয়ে উঠতে পারে অ্যাকাউন্ট্যান্ট হিসেবে আপনার ক্যারিয়ারের সমাপ্তি। কারণ একটি মাত্র ডিজিট এদিক-ওদিক হওয়াও সম্পূর্ণ প্রজেক্টকে নষ্ট করে দিতে পারে।

– চাকরির পরিস্থিতি ও সুযোগ

খাতা কলমে একজন অ্যাকাউন্ট্যান্ট সপ্তাহে ৩৫-৪০ ঘণ্টা কাজ করে থাকেন। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমরা সবাই জানি অ্যাকাউন্ট্যান্টদের কাজ গুরুত্বপূর্ণ, স্ট্রেসফুল এবং খুব বেশি পরিমাণে ডেডলাইন নির্ভর।

প্রায়ই অফিস আওয়ারের পরেও কাজ করা, এমনকি ডেডলাইন মিট করার জন্য কখনো কখনো সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও কাজ করার দরকার হতে পারে। আপনি যদি ট্যাক্স নিয়ে কাজ করেন, তাহলে বার্ষিক ট্যাক্স দেওয়ার আগের সময়টাতে সপ্তাহে ৭৫-৮০ ঘণ্টাও কাজ করার দরকার হতে পারে।

আপনি যে কোম্পানি এবং যে এলাকায় চাকরি করবেন তার উপর ভিত্তি করে হয়তো কখনো কখনো আপনাকে ক্লায়েন্টের অফিসে যেতে হতে পারে। তবে অ্যাকাউন্ট্যান্ট হিসেবে আপনার বেশিরভাগ সময়ই কাটবে নিজের অফিসে।

তবে কাজের চাপ ও স্ট্রেসের পাশাপাশি এই চাকরির ভালো দিকও আছে। এটি এমন একটি প্রফেশন যাতে আপনার কাজের অভাব হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। US Bureau of Labour Statics এর মতে, আগামী সাত বছর এই ক্যারিয়ারটি স্বাভাবিকের চেয়েও দ্রুত গতিতে প্রসার পাবে।

২। যোগ্যতা অর্জন করুন

বর্তমানে বেশিরভাগ অ্যাকাউন্ট্যান্ট অ্যাকাউন্টিং গ্র্যাজুয়েট হলেও এটাই অ্যাকাউন্টিং-এ ক্যারিয়ার গড়ার একমাত্র উপায় নয়। ভবিষ্যতে একজন অ্যাকাউন্ট্যান্ট হিসেবে কাজ করতে চাইলে নিচের যে কোনো পথই অনুসরণ করতে পারেন।

একটি এন্ট্রি লেভেল অ্যাকাউন্ট্যান্ট পদে চাকরির জন্য অনেক কোম্পানিতেই নূন্যতম যোগ্যতা হিসেবে যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অ্যাকাউন্টিং-এ MBA ডিগ্রি থাকার প্রয়োজন হয়। তাই অ্যাকাউন্ট্যান্ট প্রফেশনে যোগ দেওয়ার সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অ্যাকাউন্টিং অথবা ফিন্যান্স নিয়ে পড়াশোনা করা। আপনার ব্যাচেলর ডিগ্রি যদি অন্য কোনো বিষয়েও হয়ে থাকে, অ্যাকাউন্টিং বিষয়ে MBA করে আপনি বিভিন্ন কোম্পানিতে এই পদে চাকরির জন্য আবেদন করতে পারবেন।

তবে অ্যাকাউন্টিং নিয়ে পড়াশোনা না করেও অনেক সময় এ ধরনের পদে চাকরি করা যায়। বড় বড় কিছু কোম্পানিতে ট্রেইনি অ্যাকাউন্ট্যান্ট পদেও চাকরি দেওয়া হয়। এগুলো সাধারণত ইন্টার্নশিপ বা অ্যাপ্রেনটিসশিপ নামে পরিচিত। অর্থাৎ আপনি একই সময়ে চাকরি করতে এবং অ্যাকান্টিং সম্পর্কিত বিভিন্ন স্কিল শিখতে পারবেন। ট্রেইনি পদে অ্যাপ্লাই করার জন্য অনেক কোম্পানিই অ্যাকাউন্টিং-এ ডিগ্রি চায় না। তবে এই ধাপ থেকে সফল হতে হলে আপনার প্রায় প্রতিদিনই নিত্য নতুন স্কিল শেখার ক্ষমতা থাকতে হবে, কঠোর পরিশ্রম ও উৎসাহের সাথে কাজ করতে হবে।

এছাড়া পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়েও অ্যাকাউন্টিং সেক্টরে চাকরি করা যায়। আপনি যদি বর্তমানে একজন অ্যাকাউন্টিং টেকনিশিয়ান বা বুককিপার হিসেবে কাজ করেন, তাহলে নিজের যোগ্যতার বা পড়াশোনার ভিত্তিতে পরীক্ষা দিয়ে একজন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হয়ে যেতে পারবেন।

৩। আপনার প্রথম অ্যাকাউন্টিং পজিশন

চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হওয়ার প্রস্তুতির পাশাপাশি বিভিন্ন চাকরির ওয়েবসাইট ও অ্যাকাউন্টিং ফার্মগুলোর সোশ্যাল মিডিয়ায় চোখ রাখতে ভুলবেন না। বেশিরভাগ চাকরিতেই অনলাইনে অ্যাপ্লিকেশন করার পর আপনার কিছু পরীক্ষা নেওয়া হবে। যেগুলোর বিষয়বস্তুর মাঝে থাকে অঙ্ক কষা থেকে শুরু করে বিভিন্ন মনস্তাত্ত্বিক দিক। পরীক্ষাগুলোতে উত্তীর্ণ হয়ে গেলে নেওয়া হবে ইন্টারভিউ, যেখানে ইন্ডাস্ট্রি সম্পর্কে আপনার ধারণা এবং মোটিভেশন যাচাই করা হবে। পরীক্ষার আগে প্রস্তুতি এবং ইন্টারভিউয়ে ভালো করার টেকনিক জানা থাকলে সহজেই পেয়ে যাবেন আপনার কাঙ্ক্ষিত পজিশন।

আরেকটি দিকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। তা হলো আপনার সিভি যেন ইউনিক এবং কাঙ্ক্ষিত চাকরির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। এই ইন্ডাস্ট্রি বা পজিশনটির জন্য কেন আপনিই সঠিক ব্যক্তি – তা যেন আপনার সিভি এবং কভার লেটারে পরিস্কারভাবে উঠে আসে। কীভাবে একটি কার্যকরী সিভি তৈরি করতে হয় সে বিষয়ে সন্দেহ থাকলে সিভি নিয়ে আমাদের এই আর্টিকেলটি পড়ে আসতে পারেন।

৪। এখানেই শেষ নয়

চাকরি তো হয়ে গেল! এবার?

ক্যারিয়ারের প্রথম কয়েক বছর আপনার মনোযোগ ও সময়ের বেশিরভাগটাই ব্যয় হবে পড়াশোনা শেষ করা ও অভিজ্ঞতা অর্জনের পেছনে। চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হয়ে যাওয়ার পর আপনি নিজের ক্যারিয়ারকে পছন্দমতো গুছিয়ে নিতে পারবেন।

প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিগুলোতে সাধারণত প্রমোশনের পূর্বনির্ধারিত পলিসি থাকে, যাতে আপনার ক্যারিয়ারের পথ বেছে নেওয়া সহজ হবে। অ্যাকাউন্ট্যান্ট হিসেবে অনেকে একই সেক্টরে দীর্ঘদিন কাজ করে অ্যাসোসিয়েট থেকে ম্যানেজমেন্ট, এমনকি ডিরেক্টর লেভেলেও অগ্রসর হয়ে থাকেন। আবার অনেকে চাকরি পরিবর্তন করে কোম্পানির বিভিন্ন ডিপার্টমেন্ট, এমনকি বিভিন্ন কোম্পানিতেও কাজ করেন। অ্যাকাউন্টিং এমন একটি ক্ষেত্র যেখানে আপনি নিজের ইচ্ছেমতো যে কোনো পথে অগ্রসর হতে পারবেন।

কর্পোরেট ফিন্যান্সে কাজ করতে করতে উৎসাহ হারিয়ে ফেললে আপনার সামনে সুযোগ থাকবে ব্যক্তিগতভাবে অ্যাকাউন্টিং প্র্যাকটিস করার। গিগ অর্থনীতির এই যুগে অনেক অ্যাকাউন্ট্যান্টই এখন ফ্রিল্যান্সার হিসেবেও অ্যাকাউন্টিং প্র্যাকটিস করতে শুরু করেছেন। তাই আপনার সামনে সম্ভাবনা অপরিসীম।

অ্যাকাউন্টিং ক্যারিয়ার পাথ একই সাথে স্বাধীনতা ও স্থিতিশীলতা দেয়। এই কারণে বেশ স্ট্রেসফুল হওয়া সত্ত্বেও এটি একটি জনপ্রিয় প্রফেশন। চাইলে আপনিও হতে পারেন একজন অ্যাকাউন্টিং প্রফেশনাল!