যুগটাই এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও অনলাইন মার্কেটিং-এর। একটি নয়, বরং বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ সাইটে নিয়মিত নিজেদের উপস্থিতি ধরে রাখতে হয় প্রতিটি ব্র্যান্ডকে। তাই সোশ্যাল মিডিয়া ম্যানেজারদের ভূমিকা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
আপনি যদি নিজেকে একজন সোশ্যাল মিডিয়া ম্যানেজার হিসেবে কল্পনা করতে পারেন, তাহলে পড়তে থাকুন। কারণ এই আর্টিকেলে পেয়ে যাবেন এই সম্পর্কিত সব প্রশ্নের উত্তর।
এই ক্যারিয়ার কি আমার জন্য সঠিক?
সোশ্যাল মিডিয়া ম্যানেজমেন্টকে নিজের ক্যারিয়ার হিসেবে বেছে নেওয়ার আগেই সিদ্ধান্ত নিন যে এই ক্যারিয়ার আপনার জন্য সঠিক কিনা।
বাইরে থেকে দেখে অনেক সহজ মনে হলেও সোশ্যাল মিডিয়া ম্যানেজারদের কাজ শুধু ইন্সটাগ্রাম স্ক্রল করাতেই সীমাবদ্ধ নয়। তাঁদের আরও অনেক ক্ষেত্রে পারদর্শী হতে হয়। একজন সোশ্যাল মিডিয়া ম্যানেজারের অনলাইনে সঠিক যোগাযোগ বজায় রাখার দক্ষতা থাকতে হয়, ইন্ডাস্ট্রির নতুন সব ট্রেন্ড সম্পর্কে জানতে ও দ্রুততার সাথে অংশগ্রহণের ক্ষমতা থাকতে হয়, বিশ্লেষণাত্বক মনোভাব থাকতে হয় এবং ভালো কপিরাইটিং জানতে হয়।
আপনাকে প্রতিনিয়ত নতুন আইডিয়ার জন্ম দিতে হবে এবং কখনোই আপনি শতভাগ নিশ্চিত হতে পারবেন না যে আইডিয়াটি কাজ করবে কিনা। এ ধরনের একটি চাকরিতে আপনাকে প্রতিদিন চাপের মুখে তো থাকতে হবেই, পাশাপাশি আপনাকে হতে হবে আত্মবিশ্বাসী, সক্রিয় এবং যে কোনো পরিবেশে কাজ করতে সক্ষম।
কী ধরনের যোগ্যতা থাকতে হবে?
সাংবাদিকতা, যোগাযোগ ও মার্কেটিং সম্পর্কিত ডিগ্রি এই চাকরির জন্য সবচেয়ে উপযোগী। কিন্তু একটি ভালো কোম্পানিতে সোশ্যাল মিডিয়া ম্যানেজারের চাকরি পেতে শুধুমাত্র ডিগ্রি যেমন যথেষ্ট নয়, তেমনি আবশ্যকও নয়। যে কোনো বিষয় থেকে পড়াশোনা করেও আপনি সোশ্যাল মিডিয়া ম্যানেজার হিসেবে কাজ করতে পারেন যদি আপনি এই অবস্থানের জন্য নিজেকে যোগ্য বলে প্রমান করার ক্ষমতা রাখেন।
তার জন্য আপনাকে নতুন সব সোশ্যাল মিডিয়া ট্রেন্ড ও যে কোনো পরিবর্তনের দিকে খেয়াল তো রাখতে হবেই, পাশাপাশি বিভিন্ন SEO টুল, কন্টেন্ট তৈরি ও কিওয়ার্ড বিশ্লেষণ (keyword analysis) সম্পর্কেও পড়াশোনা করতে হবে। সৌভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, এ বিষয়ক প্রায় সব তথ্যই এখন অনলাইনে পাওয়া যায়। তাই চলুন কী কী টুল সম্পর্কে পড়াশোনা আবশ্যক তা জেনে নেই।
গুগল কিওয়ার্ড (keyword) প্ল্যানার
সোশ্যাল মিডিয়ার যে কোনো মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজির প্রথম ও অন্যতম ধাপ কিওয়ার্ড রিসার্চ। যদিও এখন অনলাইনে অনেক ধরনের কিওয়ার্ড প্ল্যানার পাওয়া যায় এবং ব্যবহৃতও হয়, এরমদ্ধে গুগলের প্ল্যানারটিই সর্বাধিক বিশ্বস্ত ও ব্যবহৃত। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কোনো পোস্ট বেশি সংখ্যক মানুষের সামনে উপস্থাপন করতে চাইলে আপনাকে অবশ্যই কিওয়ার্ড কীভাবে কাজ করে, কীভাবে তা রিসার্চ করতে হয় এবং কী উপায়ে কিওয়ার্ড ব্যবহার করে গুগলে আপনার পোস্টের র্যাংকিং বাড়ানো যায় তা জানতে হবে।
গুগল ট্রেন্ডস
এই টুলটির কাজও অনেকটা কিওয়ার্ড প্ল্যানারের মতোই। তবে পার্থক্য হচ্ছে, সার্চের ধরন অনুযায়ী ফিল্টার ব্যবহার করে পোস্টের লক্ষ্য খুবই সূক্ষ্মভাবে নির্ধারণ করা যায়। কিওয়ার্ড প্ল্যানার ও ট্রেন্ডস একসাথে ব্যবহার করে একটি শক্তিশালী ক্যাম্পেইন স্ট্র্যাটেজি গড়ে তোলা সম্ভব।
সোশ্যাল ম্যানেজমেন্ট টুল
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজেদের উপস্থিতিকে লক্ষ্যণীয় করতে একটি অন্যতম উপায় হচ্ছে পরিকল্পনা সাজানো এবং সে অনুযায়ী কন্টেন্ট গুছিয়ে পাবলিশ করা। বাফার ও হুটসুট-এর মতো সাইট গুলো আপনাকে তাতে সাহায্য করবে। এইসব সাইটের সাহয্যে কন্টেন্টের ক্যালেন্ডার তৈরি ও একই সাইট থেকে বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ার জন্য পোস্ট শিডিউল করে রেখে ম্যানেজার হিসেবে নিজের কাজ সহজ ও সাবলীলভাবে করতে পারবেন।
গুগল অ্যানালিটিকস
তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম পরিচালনা করার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই টুলটি আপনার ক্যাম্পেইন ও ওয়েবসাইটের পরিস্থিতি সম্পর্কে আপনাকে মূল্যবান তথ্য দেবে, যা ক্যাম্পেইনের রিপোর্ট থেকে পরবর্তী ক্যাম্পেইনের নকশা তৈরি পর্যন্ত অনেক কাজে লাগবে।
কী কী বিষয়ে জানতে হবে?
আগেও বলেছি, শুধুমাত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সম্পর্কে জানাই এই ক্যারিয়ারের জন্য যথেষ্ট নয়। সফল হতে চাইলে আরও কিছু বিষয়ে আপনার পর্যাপ্ত জ্ঞান এবং যোগ্যতা অর্জন করতে হবে।
বিশ্লেষণ ক্ষমতা
ক্যাম্পেইনের কোন অংশটি সঠিক ভাবে কাজ করছে, আর কোথায় পরিবর্তন আনতে হবে তা বুঝতে আপনার প্রতিদিনই বিভিন্ন সাইট থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করতে হবে।
সৃজনশীলতা
সোশ্যাল মিডিয়াতে আজকাল প্রতিযোগিতা অনেক। তাই অন্য কোম্পানি থেকে নিজেদের আলাদা করে উপস্থাপন করতে আপনাকে প্রতিনিয়ত সৃজনশীল ও উদ্ভাবনী উপায় খুঁজে বের করতে হবে।
লেখার দক্ষতা
সোশ্যাল মিডিয়া ম্যানেজারদের প্রায় প্রতিদিনই কিছু না কিছু লিখতে হয়। এবং সেই লেখাটা হয় প্রতিটি সাইটের জন্য ভিন্নরকম। একদিকে ইন্সটাগ্রামের জন্য স্বছন্দ ও হালকা ধরনের পোস্ট, অপরদিকে লিঙ্কডইনের জন্য তুলনামূলক গাম্ভীর্যপূর্ণ পোস্ট উপযোগী। তাই প্রয়োজনমতো লেখার ধরনকে পালটে নিতে পারার দক্ষতা থাকা চাই আপনারও।
ডিজাইন সম্পর্কে ধারণা
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রতিটি কন্টেন্টে লেখার পাশাপাশি ছবিও এখন সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ছবি ছাড়া একটি পোস্ট খুব কম মানুষকেই আকর্ষণ করে। সোশ্যাল মিডিয়া ম্যানেজার হিসেবে যদিও আপনার দায়িত্বের মধ্যে সে ছবি তৈরি করা পড়বে না, তবে ঠিক কোন ডিজাইনটি কোম্পানির ব্র্যান্ডিং-এর জন্য উপযুক্ত ও যথেষ্ট আকর্ষণীয় তার দিকে আপনাকেই খেয়াল রাখতে হবে।
যোগাযোগ বজায় রাখার ক্ষমতা
এই চাকরিতে আপনাকে সবসময়ই একদল সৃজনশীল ব্যক্তিদের সাথে কাজ করতে হবে। টিমের ভেতর সঠিক যোগাযোগ ধরে রাখা, তাদেরকে উপযুক্ত ফিডব্যাক দেওয়া, তাদের বিভিন্ন আইডিয়া ও মতামতের যথার্থ মূল্যায়ন এবং ব্যাবহার করা – এসবের জন্য চাই ভালো যোগাযোগ দক্ষতা।
মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল। তাই এই ক্ষেত্র নিয়ে কাজ করতে হলে পরিবর্তনকে গ্রহণ করে সেই অনুযায়ী নিজের আইডিয়া ও পরিকল্পনাকে মানিয়ে নিতে পারার ক্ষমতা আবশ্যক।
চাকরি পাবো কীভাবে?
প্রয়োজনীয়তা যেমন বাড়ছে, সোশ্যাল মিডিয়া ম্যানেজারের চাকরিগুলোর জন্য প্রতিযোগিতাও তেমনি ভাবে বাড়ছে। তাই চাকরির খোঁজে হাবুডুবু খাওয়ার আগে কোনো ইন্টার্নশিপ বা ভলান্টিয়ারিং অবস্থানে কাজ করে অভিজ্ঞতা অর্জন করার মাধ্যমে চাকরিদাতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেন। অথবা একটি ব্যক্তিগত ব্লগ শুরু করে নিজের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম প্রোফাইলগুলো ম্যানেজ করেও আপনার দক্ষতা প্রমাণ করতে পারেন।
কিছু অভিজ্ঞতা অর্জন করে সে অনুযায়ী নিজের সিভি আপডেট করার পর চাকরি অ্যাপ, বিডিজবস সহ চাকরি খোঁজার বিভিন্ন ওয়েবসাইটে সোশ্যাল মিডিয়া ম্যানেজার পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি খুঁজতে থাকুন। পাশাপাশি আপনার পছন্দের কোম্পানিগুলোর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম প্রোফাইলগুলো চাকরির সুযোগের জন্য ঘেঁটে দেখতে ভুলবেন না!
ক্যারিয়ারে উন্নতি করব কীভাবে?
চাকরি পেয়ে থেমে থাকলে তো হবে না। ক্যারিয়ারে যদি উন্নতি করতে চান, তাহলে নিজের স্কিলকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। আপনার ইন্ডাস্ট্রির সাথে সম্পর্কিত নতুন সবকিছু নিয়ে পড়াশোনা করুন, ইন্ডাস্ট্রি লিডার ও গ্রাহকদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলুন। জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জনের মাধ্যমে হয়তো একদিন আপনি আপনার স্বপ্নের কোম্পানিতে ক্রিয়েটিভ ডিপার্টমেন্টের প্রধান হিসেবে কাজ করতে পারবেন। অথবা চাইলে এই অভিজ্ঞতা ও পরিচিতিকে কাজে লাগিয়ে নিজের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম পরামর্শ সংস্থাও খুলতে পারবেন।
তাহলে সোশ্যাল মিডিয়া ম্যানেজার ক্যারিয়ার সম্পর্কে সব তথ্য তো জানা হয়েই গেল! অনলাইন ও সোশ্যাল মিডিয়ার এই যুগে আপনি যা শিখতে চান, যা জানতে চান – সবই হাতের নাগালে। তাই আর দেরি না করে প্রস্তুতি শুরু করে দিন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ে আগ্রহ আর একটু চেষ্টা থাকলেই আপনি হয়ে যেতে পারবেন একজন সোশ্যাল মিডিয়া ম্যানেজার।